ইসলামঃ শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম এবং পৃথিবী কামিয়াবী সমস্ত আমিত্বের আর্কষণ হইতে যে মুক্তিপ্রাপ্ত সেই সার্বজনীন ধর্মীওঃ মসুলমান


সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার- জাহারুল ইসলাম জীবন।

বিশ্বজুড়ে যখন ধর্মীয় বিভেদ ও সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন ইসলামের মূল চেতনা ও শান্তির বার্তা উপলব্ধি করা সময়ের অপরিহার্য দাবি। ইসলাম, আক্ষরিক অর্থে শান্তি, আত্মসমর্পণ এবং আনুগত্যের ধর্ম। এই শান্তির মর্মবাণী ধারণ করেই প্রতিটি মুসলমানের জীবন পরিচালিত হওয়ার কথা। তবে, তথাকথিত ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অপব্যাখ্যার কারণে ইসলামের প্রকৃত রূপ আজ বহুলাংশে অস্পষ্ট। এই প্রেক্ষাপটে, কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামের অন্তর্নিহিত শান্তি ও কল্যাণের বার্তা এবং একজন প্রকৃত মুসলমানের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরাই এই প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ তায়ালা মানবজাতিকে শান্তির পথে আহ্বান জানিয়েছেন। কোনো বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে, বরং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ ও শান্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে “কাফির”, “মোনাফেক” ও “অবিশ্বাসী” শব্দের উল্লেখ থাকলেও, কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা জাতির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ এর উদ্দেশ্য নয়। বরং, যারা সত্যকে জানার পরও অস্বীকার করে, কপটতা অবলম্বন করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাদেরকেই এই শব্দগুলো দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে পরিপূর্ণভাবে শান্তির পথে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা আল-বাকারা: ২০৮)
এই আয়াত স্পষ্টতই নির্দেশ করে যে, ইসলামে শান্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নই কাম্য। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় – জীবনের প্রতিটি স্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই একজন মুমিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
হাদিস শরীফেও শান্তির গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, “সে ব্যক্তি মুমিন নয়, যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়।” (সহীহ্ বুখারী)
এই হাদিস দ্বারা প্রতিবেশীর অধিকার ও তাদের প্রতি শান্তি বজায় রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। ইসলাম কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের সাথে সদাচরণ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং অন্যের কল্যাণে আত্মনিয়োগও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জিহাদঃ আত্মশুদ্ধি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামঃ ইসলামে জিহাদের ধারণাটিকে অনেকেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন। জিহাদ মূলত দুই প্রকারঃ জিহাদে আকবর (বড় জিহাদ) ও জিহাদে আসগার (ছোট জিহাদ)।
** জিহাদে আকবরঃ এটি হলো নফসের (প্রবৃত্তির) বিরুদ্ধে সংগ্রাম। মানুষের ভেতরের লোভ, লালসা, হিংসা, অহংকার ইত্যাদি কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে আত্মশুদ্ধি অর্জন করাই হলো জিহাদে আকবর। এই জিহাদে জয়ী হতে হলে পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী একজন কামেল শিক্ষকের সান্নিধ্য ও কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজন।
** জিহাদে আসগারঃ এটি হলো বাহ্যিক শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম, যা ইসলাম ও মুসলিমদের জানমাল ও সম্মান রক্ষার প্রয়োজনে বিশেষ পরিস্থিতিতে শরীয়তের নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হয়। তবে, অপরিণত জ্ঞান ও লোভী স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হত্যা, গুম ও সন্ত্রাস কখনোই জিহাদে আসগারের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং ইসলামে এর কোনো স্থান নেই।
প্রকৃতপক্ষে, জিহাদে আকবরের মাধ্যমেই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। যখন প্রতিটি মানুষ নিজের ভেতরের কলুষতাকে দূর করে পরিশুদ্ধ জীবন যাপন করবে, তখন সমাজে আপনাআপনিই শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রকৃত মুসলমান শান্তি ও কল্যাণের ধারকঃ
একজন প্রকৃত মুসলমান কেবল সেই ব্যক্তি নন, যে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে বা কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। বরং, সেই ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলমান, যার কর্মে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) আদেশ-নিষেধের প্রতিফলন ঘটে এবং যার দ্বারা মানুষ ও সৃষ্টিজগতের কল্যাণ সাধিত হয়।
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, “মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।” (সহীহ্ বুখারী)
এই হাদিস দ্বারা একজন মুসলমানের চরিত্র ও আচরণের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। যে ব্যক্তি অন্যের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার উৎস, তিনিই প্রকৃত মুসলমান।
পবিত্র কোরআনে কোনো বিশেষ ধর্ম বা জাতির নাম উল্লেখ না করে “অবিশ্বাসী”, “কাফির” ও “মোনাফেক”দের কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো, যে কোনো ব্যক্তি – সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন – যদি মানবকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ হয়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং সমাজে শান্তি বজায় রাখে, তবে সে আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারে। কারণ, আল্লাহ্ তায়ালা সমগ্র সৃষ্টিজগতের রব এবং তিনি চান তাঁর সৃষ্টি যেন শান্তিতে বসবাস করে।
আহলে বায়াত ও তাসাউফের গুরুত্বঃ সত্য ইসলামের মর্ম উপলব্ধি করতে হলে নবীজী (সাঃ)-এর আহলে বায়াত (পরিবার) এবং তাসাউফের (আধ্যাত্মিকতা) গভীর জ্ঞান অর্জন অপরিহার্য। আহলে বায়াত ছিলেন নবীজীর (সাঃ) জীবন্ত আদর্শের ধারক ও বাহক। তাঁদের জীবন ও শিক্ষা অনুসরণ করার মাধ্যমেই ইসলামের প্রকৃত রূপ অনুধাবন করা সম্ভব।
তাসাউফ হলো আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ। এর মাধ্যমে মানুষ নিজের ভেতরের কুপ্রবৃত্তি দমন করে পরিশুদ্ধ হৃদয় অর্জন করে এবং আল্লাহর প্রেমের রঙে রঙিন হয়। এলমে তাসাউফ বা আল্লাহ্ প্রদত্ত হুজুরী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা যায় এবং জগতের রহস্য উন্মোচিত হয়।অন্যদিকে, যারা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তারা কখনোই ইসলামের প্রকৃত অনুসারী হতে পারে না। তারা বাতেল ও মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের পথভ্রষ্টতা বিশ্বমানবতার জন্য এক ভয়াবহ হুমকি।
বিশ্ব শান্তি ও মানবতার মুক্তিঃ ইসলামের মূল লক্ষ্য হলো বিশ্ব শান্তি ও মানবতার মুক্তি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করাই ইসলামের শিক্ষা। যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে, হানাহানি ও রক্তপাতের জন্ম দেয়, তারা কখনোই ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।
আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের সকলকে সত্য পথের সন্ধান দান করুন এবং ইসলামের শান্তির বার্তা উপলব্ধি করে তা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের তৌফিক দান করুন। আসুন, আমরা সকলে মিলেমিশে একটি শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণময় বিশ্ব গড়ে তুলি, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিরাপদে ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে। এটাই ইসলামের শাশ্বত বাণী এবং এটাই একজন প্রকৃত মুসলমানের জীবনের লক্ষ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *